অগ্রদৃষ্টি ডেস্কঃ গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ এবং কিশোরগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়ায়, দেশের বৃহত্তম ঈদ জামাতের কাছে জঙ্গি হামলায় ভাবিয়ে তুলছে দেশের সর্বস্তরের মানুষকে।
মাদরাসার ছাত্ররাই শুধু জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত এমন প্রচলিত ধারনার উল্টো চিত্র ফুটে উঠেছে দুটি জঙ্গি হামলায়। সমাজের উঁচু স্তরের পরিবারের সন্তান বা নামীদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাই এই ন্যাক্কারজনক হামলায় জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন অভিভাবক জাতি এবং বিশ্ববাসীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন।
শুরু থেকেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা ছিল। বিত্তবান এবং ক্ষমতাবান পরিবারের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। প্রশ্ন উঠছে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেনীর তরুণরাই কেন ঝুঁকে পড়ছে সন্ত্রাসবাদের দিকে? আর এই কেন,র উত্তর খুজছে অভিজ্ঞমহল। সামাজিক গনমাধ্যমেও এ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষন। পক্ষে বিপক্ষে চলছে নানান যুক্তি তর্ক -বির্তক। তবে জঙ্গিবাদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠাকে ভয়াবহ উল্লেখ করে করে এই মূহূর্তে জাতীয় ঐক্যের তাগিদ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর জাতির উদ্দেশে ভাষনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ যখন একটি আত্মমর্যাদাশীল এবং আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তখন দেশি-বিদেশি একটি চক্র এ দেশের অগ্রযাত্রা বানচালের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। অস্ত্রের মুখে নিরীহ সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে এরা দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করাতে চায়।
প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস প্রতিরোধে এগিয়ে আসার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ইটালি ও ভারতের নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনায় শোক ও সমবেদনা জানিয়ে চার রাষ্ট্র প্রধানকে চিঠি দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এর আগে এক বিবৃতিতে দুষ্কৃতিকারীদের নির্মম রক্তাক্ত অভ্যুত্থান’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেন, এ অভ্যুত্থান দেশে বিরাজমান দুঃশাসনেরই বহিঃপ্রকাশাশ। তিনি বলেন, সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এখনই এই উগ্রবাদী শক্তিকে দমন করতে না পারলে এরা দীর্ঘতম যুদ্ধ চালিয়ে দেশের জনগণের শান্তি, নিরাপত্তা বজায় রাখা কঠিন করে তুলবে।
অবশ্য বেগম জিয়ার এই বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, একদিকে খালেদা জিয়া জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন। আবার বলছেন, যতোক্ষণ পর্যন্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হবে, ততোক্ষণ পর্যন্ত এ হত্যাকাণ্ড চলতে থাকবে। এসব কথা বলে তিনি সন্ত্রাসীদের উস্কে দিচ্ছেন। তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, তারা একটি ঘটনা ঘটিয়ে সুবিধা নিতে চায়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ খালেদা জিয়ার আহ্বান নাকচ করে দিয়ে জামায়াত সঙ্গ ত্যাগের বিষয়টি তোলেন। এই প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন ক্ষমতাসীনরা জাতীয় ঐক্যে না এসে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করছে। দেশের সংকটে আমরা দলমত নির্বিশেষ জাতীয় ঐক্য চাই। এদিকে জাতিসংঘ, আমেরিকা, বন্ধুপ্রতীম দেশ ইন্ডিয়া সহ বিদেশি অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশের চলমান এই অস্থিরতাকে গুরুত্বের সাথেই নিয়েছে।
গুলশানের রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোনে বলেন সন্ত্রাস নির্মূলে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহায়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত। এক বিবৃতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন হামলায় হতাহতের পরিবার, বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
বান কি মুন বলেন, বাংলাদেশ যে হুমকির মুখোমুখি হয়েছে, তা মোকাবিলায় তিনি দেশটির পাশে আছেন। সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। অন্যদিকে রাজধানীর গুলশানের আর্টিসান রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোনে ঢাকা হামলার নিন্দা জানান এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে দেয়া একাধিক পোস্টে বাংলাদেশের জনগণের পাশে ভারত রয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
গুলশানে জিম্মি সংকট চলাকালেই আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা আমাক নিউজ কিছুক্ষণ পরপর সবার আগে রেস্তোরাঁর ভেতরে কী চলছে, তার তথ্য প্রচার এবং উদ্ধার অভিযান শুরুর প্রায় চার ঘণ্টা আগেই জঙ্গিদের হাতে খুন হওয়া দেশি-বিদেশিদের রক্তাক্ত ছবি প্রকাশ করে। অবশ্য বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক আইএসের দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলাকারী গোষ্ঠীই শোলাকিয়ায় হামলা চালিয়েছে। দুটি হামলাই করেছে দেশি জঙ্গিগোষ্ঠী জেএমবি (জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ)।
আইজি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আইএস তো যুক্তরাষ্ট্রের নৈশক্লাবে ৫০ জন নিহত হওয়ারও দায় স্বীকার করেছে। সারা বিশ্বে যেখানেই হামলা হয়, আইএস সেটারই দায় স্বীকার করে। আইএস কেন সবকিছুর দায় স্বীকার করে, কার মাধ্যমে করে, তার লিংক আমরা এখনো খুঁজে পাইনি।
গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে সন্ত্রাসী হামলার পর দূতাবাসগুলোর সামনে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। নিরাপত্তার স্বার্থে সার্বক্ষণিক নজর রাখা হচ্ছে বিদেশিদের চলাফেরায়। কূটনৈতিক এলাকার নিরাপত্তায় কাজ করছে পুলিশের তিনটি বিভাগ।
এদিকে জঙ্গি হামলা নিয়ে রাজনীতিবীদদের বাকযুদ্ধ চলছে বেশ জোরেসোরইে। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বর্তমান গণতান্ত্রিক ও নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে সরকার জঙ্গিবাদী অশুভ শক্তিকে জিইয়ে রাখতে চাইছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, জঙ্গিদের রক্তক্ষয়ী কর্মকাণ্ডের দিকে জনগণের দৃষ্টি থাকলে সরকারের প্রতি পদত্যাগের চাপ কমে যাবে। তাই সরকার জঙ্গিবাদী তৎপরতায় হালকা বোধ করে। অভিজ্ঞমহল মনে করে দোষরাপ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তা জাতীয় দূর্যোগে পরিণত হবে।
উগ্রপন্থা ও জঙ্গিবাদের বিস্তার বিচ্ছিন্ন বা স্বতঃস্ফূর্ত কোন ঘটনা নয় বলে উল্লেখ করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান ও সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। আর এই ঘটনাকে দেশের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা বলে মন্তব্য করেছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবীদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, জাতির যে ক্ষতি হয়ে গেল তা সামান্য নয়। যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এটা তো একটা ঘটনা দিয়ে শেষ হবে না। এর হয়তো বহু রকমফের আমরা দেখব। যে ভয়াবহতার মধ্যে আছি, এর মূলোৎপাটন করে ফেলতে হবে। এদিকে বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমনে সক্ষমতা তৈরিতে বিশেষজ্ঞ সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
আজ রোববার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে এ প্রস্তাব দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল।
ষড়যন্ত্রের জালে কঠিন সংকটে দেশ। দীর্ঘমেয়াদে জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান অসম্ভব এমনটিই অভিমত অভিজ্ঞমহলের।